ঘাড় ব্যথা প্রতিদিনের জীবন-যাপনে আমাদের প্রায় সবারই হয়ে থাকে, এটি একটি প্রচলিত সমস্যা। মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশকে মেডিক্যাল এর ভাষায় সারভাইক্যাল স্পাইন বলে।
আমাদের মেরুদণ্ডে ৫ ধরনের কশেরুকা আছে। মোট কশেরুকা আছে ৩৩ টি , তার মধ্যে ঘাড়ে আছে ৭ টি । দুই কশেরুকার মাঝখানে আছে ডিস্ক, লিগামেন্ট আর পেশি । বিভিন্ন কারনে ঘাড় ব্যাথা হয়ে থাকে । সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা ঘাড় ব্যাথা থেকে নিরাময় পেতে পারি এবং আমরা যদি মনে রাখি যে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম তাহলে ঘাড় ব্যথা হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারি ।
ঘাড় ব্যথার কারণ
- ঘাড়ের অবস্থানগত ত্রুটির জন্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অস্বাভাবিকভাবে ঘাড় বাঁকা করে কোনো কাজ করলে (যেমন- কম্পিউটারে কাজ করা, টেলিভিশন দেখা, লেখালেখি বা গৃহস্থালির কাজ করা) ঘাড়ের মাংসপেশি, স্নায়ু ও হাড়ের ওপর বেশি চাপ পড়ে, ফলে ঘাড় ব্যথা হয়। (একে বলা হয় পজিশনাল বা পসচারাল নেক পেইন)।
- ঘাড়ের মাংসপেশি কোনো কারণে শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাত হওয়া (টরটিকলিস)। আমাদের ঘাড়ের দুই পাশে দু’টি প্রধান মাংসপেশি থাকে। যার নাম স্টারনোক্লেইডোমাস্টয়েড। এই মাংসপেশি আমাদের ঘার নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। কোনো কারণে এই মাংসপেশি শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাত হলে ঘাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়।
- ঘাড়ের মাংসপেশি বা লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া (স্প্ৰেইন/স্ট্রেইন)।
- ঘাড়ে অতিরিক্ত হাড় থাকা (সারভাইকেল রিব)। এই অতিরিক্ত হাড়ের ফলে ঘাড়ের রক্তনালী ও স্নায়ুতে চাপ পড়ে। ফলে ঘাড়ে ব্যথা হয়।
- ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্ক সরে যাওয়া (ডিস্ক প্ৰলাপস)।
- ঘাড়ের হাড়, জোড়া বা ডিস্কের ক্ষয় বা বৃদ্ধি (সারভাইকেল স্পনড়াইলোসিস)। এটি বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। এতে ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী স্থান কমে যায় এবং আক্রান্ত হাড়ে হুকের মতো ছোট ছোট হাড় বৃদ্ধি পায়, যাকে অস্টিওফাইট বলে। যার ফলে ঘাড়ের স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং রোগী ব্যথা অনুভব করে।
- ঘাড়ের হাড় ভেঙে যাওয়া (ফ্রাকচার) বা হাড় ভেঙে সরে যাওয়া (ফ্রাকচার ডিসলোকেশন)।
- ঘাড়ের হাড় সরে যাওয়া (স্পনডাইলোলিসথেসিস)।
- ঘাড়ের ইনফেকশন (সেপটিক, যক্ষ্মা)।
- ঘাড়ের হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া। এতে হাড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়, হাড় ছিদ্ৰযুক্ত হয় এবং হাড়ের গঠন নষ্ট হয়ে যায়, ফলে হাড় ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়। বয়স্ক পুরুষ বা নারী ও মেনোপজ পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষয়প্রাপ্ত হাড় ঘাড় ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ (অস্টিওপোরোসিস)।
- ঘাড়ের হাড়ের বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ জনিত রোগ (রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এনকাইলজিং স্পনডাইলাইটিস)।
- উচ্চ রক্তচাপ।
- মাথায় ভারী জিনিস বহন করা।
ঘাড় ব্যথার উপসর্গ
- ঘাড় ব্যথা ঘাড়েই সীমাবদ্ধ থাকা।
- ঘাড় ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত হয়ে আঙ্গুল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। হাত বা হাতের আঙুল অবশ অবশ ভাব অথবা ঝিঁঝিঁ হতে পারে। (রেডিকুলার নেক পেইন, যেমন- ঘাড়ে ডিস্ক প্ৰলাপস)।
- কাঁধ, বাহু, হাত বা হাতের আঙ্গুল দুর্বল হতে পারে।
- সময় সময় হাড় জমে (স্টিফনেস) থাকা এবং আস্তে আস্তে তা বাড়তে পারে।
- ঘাড়ের নড়াচড়া বা সামনের দিকে ঝুকে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
ঘাড় ব্যথার পরিক্ষা নিরীক্ষা
- রক্ত পরীক্ষা।
- প্রস্রাব পরীক্ষা।
- ব্লাড সুগার, ইউরিক এসিড, আরএ ফ্যাক্টর।
- ঘাড়ের এক্স-রে
- সিটিস্ক্যান
- এমআরআই ইত্যাদি।
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা
১) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা নেয়া ।
২) পরিমিত বিশ্রাম নেয়া।
৩) ঘাড়ে গরম সেক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
৪) চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছু ব্যথার ঔষধ সেবন করতে পারেন, যেমনঃ NSAID, Muscle relaxant, Vitamin & Minerals জাতীয় ওষুধ সেবন করা।
৫) প্রয়োজন অনুসারে (যেমন- দূরে কোথাও যেতে হলে) সারভাইকেল কলার ব্যবহার করা।
৬) সারভাইকেল ট্রাকসন (সারভাইকেল রেডিকুলোপ্যাথি বা সারভাইকেল কেনেল স্টেনোসিস অথবা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিসের ক্ষেত্রে।
৭) পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- হাড়সহ ছোট মাছ, দুধ, ডিম খাওয়া।
৮) সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ জাতীয় ওষুধ যেমন : Calbo-D সেবন করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে (যেমন- ঘাড়ের ডিস্ক বেশি পরিমাণে বের হয়ে স্নায়ুতে চাপ দেয়া, ঘাড়ের হাড় ভেঙে বাহু, হাত অবশ হয়ে যাওয়া, ঘাড়ের যক্ষ্মা ইত্যাদি)।
ঘাড় ব্যথা হলে করণীয়
সামনের দিকে ঝুকে কাজ না করা,কাজের মাঝে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া । যারা কম্পিউটারে কাজ করেন তাদের মনিটর চোখের লেভেল অনুযায়ি রাখুন । যাতে খুব বেশি ঝুকতে না হয়।
শোবার সময় একটা মধ্যম সাইজের বালিশ ব্যবহার করবেন যার অর্ধেক টুকু মাথা এবং বাকি অর্ধেক টুকু ঘাড়ের নিচে থাকবে । কারন খুব উচু বা খুব নিচু বালিশ ব্যবহারে আমাদের সারভাইক্যাল স্পাইনের স্বাভাবিক বক্রতাকে নষ্ট করে দেয় যার কারনে ঘাড়ে ব্যাথা হতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ ঘাড় ঝুকিয়ে বা বাকিয়ে না রাখা ।
শরীরের ওজন কমানো।
শুয়ে টিভি না দেখা ।
কাজের মাঝে মাঝে বসে থেকে বা দাড়িয়েও কিছু ব্যায়াম করা যায় কিছু ব্যায়াম করার মাধ্যমে আমরা ঘাড় ব্যাথা কমাতে বা প্রতিরোধ করতে পারিঃ
১) একটি চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন । সামনের দেয়ালের দিকে তাকান। মাথার পিছনে দুটো হাত রাখুন ,মাথার পুরো ভার হাতের উপর দিয়ে চাপ দিন। আবার উল্টো দিক থেকে হাত দিয়ে মাথাকে চাপ দিতে থাকুন, ঘাড়ে চাপ পরবে। এবার একই ব্যায়াম কপালের বদলে মাথার পিছনে, দুই পাশে, ও থুতনিতে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে করুন। প্রতিটি ব্যায়াম প্রতিদিন ১০ বার করুন।
২) কাঁধ উচু নিচু করুন এবং ডানে বামে ঘোড়ান। কাজ করতে করতে এই কাজ গুলো করা যায় ।
৩) এছাড়া, বুকের প্রসারণ- আমরা অধিকাংশ সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বাঁকা হয়ে অনেক সময় ধরে কাজ করি। তাই এই ব্যায়ামটি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম টি সঠিক ভাবে করতে হবে- (আপনার হাত দুটি পিছনে দিয়ে দুই হাতের আঙ্গুল একসাথে জড়িয়ে রাখুন এবং চাপ দিন। যতক্ষন না আপনার বুক প্রসারিত অনুভুত হয় ততক্ষন আলতো ভাবে চাপ দিন)।
৪) মেরুদণ্ডের মোড়ঃ মেঝেতে পা দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় এবং মেরুদণ্ড সোজা রেখে ধীরে ধীরে ঘাড় এবং শরীরের উপরের অংশ এক পাশে ঘোরান ,আরও গভীর ভাবে করার জন্য চেয়ারের হাতল গুলিতে আপনার হাত দুটো ব্যবহার ক্রুন। ১০ -৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং পুনরাবৃত্তি করুন ।
সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিন, ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
পরিশেষে:
ঘাড় ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিরক্তিকর হতে পারে।
কিছু টিপস:
- আপনার ব্যথার কারণ বের করুন: ব্যথার কারণ জানা গেলে তা প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
- ঘরোয়া উপায় ব্যবহার করুন: ঘরোয়া উপায় ব্যবহার করে অনেক সময়ই ব্যথা কমানো সম্ভব।
- প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন: ব্যথা তীব্র হলে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আশা করি এই তথ্যগুলো আপনার ঘাড় ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে।